গাছের যে অংশ থেকে প্রাপ্ত নতুনভাবে আরেকটি গাছ জন্মানোর কাজে যেটি ব্যবহার করা হয় তাকে বীজ বলা হয়। মূল বীজ হিসেবে সাধারনত কিছু কিছু গাছের লতা-পাতা, কিছু গাছের ফুল, কিছু গাছের ফল, কিছু গাছের কান্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বীজ গুণগত বা মানসম্পন্ন না হলে ভালো গাছ জন্মায় না।
আবার বীজ উন্নত হলেই যে বীজের ফলন ভালো হবে এটাও ঠিক নয়। বীজ যদি অন্য জাতের বীজের সাথে মিশ্রণ যুক্ত থাকে তাহলে ফলন ভালো হবে না। ভালো বীজের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো হল: মিশ্রণ মুক্ত থাকতে হবে, বীজ দাগ মুক্ত হতে হবে, বীজ পরিষ্কার এবং পরিপুষ্ট থাকতে হবে, বীজের রং স্বাভাবিক হবে এবং অঙ্কুরোদগমের ক্ষমতা থাকতে হবে কমপক্ষে ৮০ ভাগ।
আজকের আর্টিকেলে আমরা ভালো বীজ কী, ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য, যেভাবে ভালো বীজ বাছাই করবেন, ভালো বীজ কোথায় পাবো ও ভালো বীজ গুরুত্বপূর্ণ কেন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাই ভালো বীজ সম্পর্কে জানতে আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
তো আপনি যদি ভাল বীজের এসব প্রয়োজনীয় দিকসমূহ সম্পর্কে জেনে না থাকেন, তাহলে আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে একেবারে শেষ অবদি মনযোগ সহকাড়ে পড়তে থাকুন, তাহলে আশা করছি বীজ নিয়ে অজানা তথ্যগুলো জানতে পারবেন। তাহলে আসুন, আর বেশি কথা না বাড়িয়ে আমরা প্রথমেই ভালো বীজ কী তা বিস্তারিত জেনে নেই।
ভালো বীজ কী
ফসল উৎপাদন করার জন্য মানসম্পন্ন এবং গুণাবলিসম্পন্ন বীজকে ভালো বীজ বলা হয়। আর সাধারনত ভালো ফসল জন্মায় গুণগত মানসম্পন্ন বীজ থেকেই। অনেক সময় বীজ উন্নত জাতের হওয়া সত্তেও বিভিন্ন কারণবশত বীজের ফলন খারাপ হতে পারে। বীজে এমন অনেক কিছু থাকতে পারে, যা অনেক সময় উন্নত জাতের বীজকেও নির্গুণ করে দেয়।
বীজ কত প্রকার ও কি কি
কৃষি কাজে ফসল উৎপাদনের জন্য যে বীজ ব্যবহার করা হয় সেসব বীজকে ২ ভাগে ভাগ করা হয় যথাঃ
- উদ্ভিদ তাত্ত্বিক বীজ,
- কৃষি বীজ।
অপরদিকে বীজের শ্রেণি বিন্যাস অনুসারে বীজকে প্রধান ৩ ভাগে ভাগ করা হয় যথা:
- ব্রিডার ব্রিজ,
- ভিত্তিবীজ,
- প্রত্যায়িত বীজ।
আশা করছি আপনারা এই অংশ থেকে বীজ কত প্রকার ও কি কি সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারনা পেয়েছেন। এবার চলুন, ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য গুলো জেনে নেওয়া যাক।
ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য
ফসল উৎপাদন করতে হলে আমাদের যেমন সঠিকভাবে ও নিয়মিত সার, সেচ, কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে ঠিক তেমনি ভালো মানের বীজ সংগ্রহ করাটাও খুব জরুরী।
কৃষি উৎপাদনের মূল চাবিকাঠি হিসেবে বীজ পরিচিত। কৃষি কাজে ভালো ফলাফল পেতে হলে ফসল উৎপাদনের জন্য ভালো মানের বীজ চিনতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। ভালো বীজের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ও গুনাগুন নিচে তুলে ধরা হলো:
১) অংকুরদগম ক্ষমতা ৮০ শতাংশ হতে হবে
ভালো বীজের বৈশিষ্ট্যর মধ্যে অংকুরদগম ক্ষমতা হচ্ছে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। আপনি যদি জমিতে ৫০টি বীজ বপন করেন তাহলে আপনি কতটি সুস্থ চারা পাবেন তা নির্ভর করে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতার উপর। আপনি আপনার জমিতে প্রচুর পরিমাণে সুস্থ চারা পাবেন যদি বীজের এই ক্ষমতা ৬০ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে হয়।
২) উজ্জ্বল রঙের বীজ নির্বাচন করুন
বীজের অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উজ্জ্বল রঙের বীজ। কেননা ফসল ভেদে বীজের রং আলাদা হয়ে থাকে। কিন্তু বীজ যে রঙেরই হোক না কেন আপনাকে একটি বিষয় খেয়াল করতে হবে সেটা হল বীজ যেন চকচকে এবং উজ্জ্বল রঙের হয়। বীজ যদি ফ্যাকাস কালারের হয় তাহলে সেখান থেকে ভালো চারা কিংবা ফসল কখনোই উৎপন্ন করা সম্ভব হবে না। আবার বীজে যাতে কোন ময়লা না থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
৩) বীজের আর্দ্রতা
ভালো বীজের মধ্য আরও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর আদ্রতা। ধান, গম এবং ভুট্টা বীজের আদ্রতা কমপক্ষে ১২ শতাংশ থাকতে হবে। আর অন্যদিকে যেকোনো শষ্য জাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা কমপক্ষে ৯ শতাংশ থাকতে হবে।
৪) বীজের আকার
ভালো জাতের বীজগুলো মূলত প্রায় একই আকারের হয়। বীজগুলো আসলে ভালো জাতের কিনা তা বীজের পরিপক্কতা এবং পুষ্টতা দেখেই নির্ধারণ করা যায়। ভালো বীজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা যায় যে বীজের আকার যেমন একই রকম হয় তেমনি প্রতিটা বীজের ওজনও ঠিক একই রকমই থাকে।
৫) বীজের তেজ
কৃষি জমিতে যদি প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হয় তাহলে বীজের তেজ বেশি থাকলে ভালো মানের চারা উৎপাদিত হয়। বীজের তেজ বেশি থাকলে চারা উৎপাদনের ক্ষমতা সহজেই হারায় না। এছাড়া বীজের তেজ বেশি থাকলে চারা খুব দ্রুত গজায়।
৬) বীজের সুপ্ততা
বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেই জলবায়ু প্রয়োজন যেই জলবায়ু বিদ্যমান থাকার পরেও যখন বীজ অঙ্কুরিত হয় না তখন সেই অবস্থাকে বীজের সুপ্ততা বলা হয়ে থাকে। বীজ ভালো রাখতে হলে সুপ্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বীজ সুপ্ত না থাকলে অনুকূল পরিবেশেও বীজ দীর্ঘমেয়াদি ভালো থাকে এবং নষ্ট হয় না।
৭) বীজের বিশুদ্ধতা
বীজের বিশুদ্ধতা বলতে বোঝায় বীজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে, ধুলাবালি বিহীন হবে, অন্য বীজের সংমিশ্রণ থাকবে না, পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হতে হবে। এক্ষেত্রে শস্য জাতীয় বিভিন্ন বীজ যেমন: ধান, গম, পাট, মসুর, বাদাম এবং মাসকলাই বীজের বিশুদ্ধতা থাকতে হবে ৯৬ থেকে ৯৮%।
আশা করছি আপনারা এই অংশ থেকে ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারনা পেয়েছেন। এবার চলুন, যেভাবে ভালো বীজ বাছাই করবেন তা জেনে নেওয়া যাক।
যেভাবে ভালো বীজ বাছাই করবেন
আপনারা অনেকেই জানতে চেয়েছেন যে ভালো বীজ বাছাই করব কিভাবে? মূলত এজন্যই আমরা পোষ্টের এই অংশে ভালো বীজ বাছাই করার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। তাহলে চলুন, আর বেশি কথা না বাড়িয়ে এ বিষয়ে নিচের অংশ থেকে জেনে নেওয়া যাক।
📌আরো পড়ুন 👇
ভালো বীজ বাছাই করার ক্ষেত্রে মূলত ২ টি উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে যথাঃ
- ফ্লোটেশন পদ্ধতি,
- দেখে বাছাই করা।
১. ফ্লোটেশন পদ্ধতি
অনেকেই বলেন যে ভালো বীজ শুধুমাত্র দেখেই ভালোভাবে বাছাই করা যায়। কিন্তু বর্তমানে ভালো বীজ দেখে বাছাই করার থেকেও ফ্লোটেশন পদ্ধতিতে বীজ বাছাই করা বেশ জনপ্রিয়। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে প্রথমত আপনাকে বীজ একটি বড় পাত্রে পানি নিয়ে বীজগুলো পানিতে ঢেলে দিতে হবে।
তারপরে কিছু সময় পর খেয়াল করলে দেখবেন যে, যেগুলো ভালো বীজ সেগুলোর নিচে পড়ে রয়েছে এবং নষ্ট বীজ গুলো উপরে ভেসে উঠে এসেছে। উপর থেকে নষ্ট বীজ এবং পানিগুলো ফেলে দিলেই ফ্লোটেশন পদ্ধতিতে বীজ বাছাই করতে পারবেন।
২. দেখে বাছাই করা
বীজ দেখে বাছাই করার ক্ষেত্রে আপনাকে একটি একটি করে বীজ হাতে নিয়ে ভালোমতো দেখতে হবে যে আসলে কোনটি খারাপ অথবা কোন বীজটি ভালো। খারাপ বীজগুলো আলাদা করতে হবে এবং ভালো বীজগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
আশা করছি আপনারা এই অংশ থেকে যেভাবে ভালো বীজ বাছাই করবেন সেই সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পেয়েছেন। এবার চলুন, ভালো বীজ চেনার উপায় জেনে নেওয়া যাক।
ভালো বীজ চেনার উপায়
আমাদের এই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে মূলত কৃষি। আর যে কোনো ফসল উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বা উপকরণ হচ্ছে ভালো বীজ। কৃষি নির্ভর এ দেশের খাদ্যর চাহিদা মেটানোর জন্য এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য প্রয়োজন উন্নত ও মানসম্মত বীজ ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
কৃষি গবেষণায় দেখা গেছে, একই ব্যবস্থাপনায় মানসম্পন্ন ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ফলন পাওয়া সম্ভব। ফসল উৎপাদনের জন্য প্রধান উপকরণ হচ্ছে বীজ অর্থাৎ, বলা যায় যে বীজ হচ্ছে সমস্ত ফসলের প্রাণ। ‘ভালো বীজে ভালো ফসল’ এটি চিরন্তন সত্য এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিটা বীজ ক্রেতা-বিক্রেতা, ব্যবসায়ী ও কৃষকদের পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে ভালো বীজ তথা মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের গুণাবলী এবং চেনার উপায়। তাহলে চলুন ভালো বীজ চিনবেন যেভাবে তা জেনে নেই-
বীজ যে জাতের সে জাতের নির্দিষ্ট গুণাবলী অবশ্যই থাকতে হবে। জাতীয় বীজ র্বোডের অনুমোদিত বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজের বিশুদ্ধতা হতে হবে ৯৬% হতে ৯৯% ভাগ।
ভালো বীজ অবশ্যই সব ধরনের মিশ্রণ মুক্ত হতে হবে অর্থাৎ, একটি ভালো বীজে জড় পদার্থ, আগাছার বীজ বা অন্য ফসলের এমনকি অন্য জাতের মিশ্রণ থাকা চলবে না। অন্য ফসলের বীজ বা আগাছার বীজ থাকতে পারে।
বিশুদ্ধ ভালো বীজ অবশ্যই রোগ জীবাণুমুক্ত এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হতে হবে। ভালোবীজ মানেই উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ অর্থাৎ অংকুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে ৮৫% বা তার ওপরে।
নির্দিষ্ট ফসলের নির্দিষ্ট জাতের সব বীজ প্রায় একই আকারের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপক্ব ও পুষ্ট হতে হবে। এছাড়া বীজের জীবনীশক্তি এবং বীজের স্বাভাবিক উজ্জ্বল রঙ থাকতে হবে।
আশা করছি আপনারা এই অংশ থেকে বীজ কাকে বলে বা বীজ সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারনা পেয়েছেন। এবার চলুন, বীজ কত প্রকার ও কি কি তা জেনে নেওয়া যাক।
ভালো বীজ কেন গুরুত্বপূর্ণ
ভালো বীজ একটি ফসলের জন্য আসলে কেন বা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিম্নে উল্লেখ করে দেয়া হল:
- মানসম্মত ফসল পাওয়ার জন্য,
- কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং লাভবান হওয়ার জন্য,
- জমিতে সঠিক সংখ্যায় চারা উৎপাদন করার জন্য,
- দ্রুত বীজ থেকে চারা গজানোর জন্য,
- চারার দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য,
- ফলন বেশি পাওয়ার জন্য।
আশা করছি আপনারা এই অংশ থেকে ভালো বীজ কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারনা পেয়েছেন। এবার চলুন, ভালো বীজ কোথায় পাবো তা জেনে নেওয়া যাক।
ভালো বীজ সম্পর্কে লেখকের মতামত
যেকোনো জমি থেকে ভালো মানের ফসল পাওয়ার জন্য অবশ্যই ভালো বীজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বীজ যাচাই-বাছাই করার আগে অবশ্যই আপনাকে জানতে হবে ভালো বীজ কি, ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য, ভালো বীজ চেনার উপায় এবং ভালো বীজ কেন গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিস্তারিত যাবতীয় তথ্য।
আজকের এই সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ে ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আপনাদের মাঝে কোন ধরণের মতামত কিংবা প্রশ্ন থাকলে তা কমেন্ট করে জানাবেন অবশ্যই। এমন আরো শিক্ষামূলক গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পড়তে বা তথ্য পেতে আমাদের এই কাটিং টু ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করুন।